বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১, ০২:৩৯ অপরাহ্ন

চীন থেকে যেভাবে দেশে এলাম

এ যেন দেড় মাসের বন্দিদশা, যার শুরুটা চীনে। অনিশ্চয়তার দিন কাটিয়ে আসি ভারতে। সেখানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকি। অতঃপর পা রাখি প্রিয় দেশে, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে। সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা কিছুতেই ভুলে থাকতে পারছি না।
চীনে তখন ছুটি
এ বছরের শুরুতে শীতকালীন ছুটির সঙ্গে যোগ হয়েছিল চীনা নববর্ষের ছুটি। একসঙ্গে বেশ কিছুদিন ছুটি পেয়ে স্বামীসহ গিয়েছিলাম ঘুরতে। আমরা চীনের হুবেই প্রদেশের জিংমেন শহরে থাকি, আমি সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ি। ঘোরাঘুরির শেষ পর্যায়ে শুনতে পাই নতুন একটি ভাইরাসের আবির্ভাবের কথা। নাম তার নভেল করোনাভাইরাস। ঘোরাঘুরি শেষে ২২ জানুয়ারি আমরা ফিরে আসি জিংমেন শহরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুদিন পর শহরটি অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। আমাদের হোস্টেলটিও সিলগালা করা হয়। শহরের জন্য একটি অনলাইন দোকান ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয় সব দোকানপাট। অনলাইন দোকান থেকেই খাবার কিনতে হতো, সেসব পুলিশ নিজে এসে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে যেত। গৃহবন্দী জীবনের সেই শুরু।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছুদিন পরপরই বিনা মূল্যে চাল, সবজিসহ নানা খাবার দিয়ে যেতেন আমাদের। এরই মধ্যে একদিন চীনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে কল এল উহানে একটি বিশেষ বিমান আসছে। চীনে করোনাভাইরাসে প্রথম কাবু হয়েছিল এই শহরের মানুষ। সেই উহান শহর থেকে ২০৪ কিলোমিটার দূরত্বে জিংমেন।
শহরে আমরা ৯ জন বাংলাদেশি ছিলাম। বিশেষ বিমানে সবাই ফেরার প্রস্তাব পেয়েছিলাম, কিন্তু নানা দিক বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বাংলাদেশে ফিরব না। তখনো বাংলাদেশে চীনের বাইরে করোনা ততটা ছড়ায়নি। আমরা চাচ্ছিলাম চীনের মতো অবস্থা বাংলাদেশের না হোক। আমাদের পরিবারের মানুষেরা সুস্থ থাকুক। করোনাভাইরাস আমাদের দ্বারা দেশে প্রবেশ না করুক।
এরপর দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকল। দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকল। দেশে দেশে ছড়াল ভাইরাসের প্রকোপ। আমাদের পরিবার দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে থাকল। একদিন ঘোষণা এল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে মহামারি ঘোষণা করেছে। তখন ভাবলাম, যদি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে যায়, তাহলে এই বিপদে আমাদের পরিবারের সঙ্গে থাকাই ভালো। বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করি। পুরো শহর যেহেতু অবরুদ্ধ, তাই নিজেদের ব্যবস্থায় ফেরা সম্ভব ছিল না। হাইকমিশন থেকেও আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়, কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ আর কোনো বিশেষ উড়োজাহাজ শহরে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছিল না। আমরা সবাই আশাহত হই।
দিল্লিতে কোয়ারেন্টিন সময় শেষে সনদ নিচ্ছেন লেখক।
দিল্লিতে কোয়ারেন্টিন সময় শেষে সনদ নিচ্ছেন লেখক।
চীন থেকে ভারতে
এমনই একদিন আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের কাছে জানতে পারি, ভারত থেকে একটি বিশেষ সামরিক উড়োজাহাজে ওষুধ নিয়ে আসা হবে। সেই উড়োজাহাজে ভারতীয় নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তখন আমরা ভারতীয় হাইকমিশনে ই-মেইল পাঠাই। তারা ই-মেইলটির সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। জানানো হয়, আমাদের উদ্ধার করতে পারলে তারা অনেক খুশি হবে। আমরা বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তারা ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ২০ ফেব্রুয়ারি আমরা ভারতীয় ভিসা ফরমসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কখন আমাদের নিতে গাড়ি আসবে। একসময় জানতে পারি, উড়োজাহাজটি আসছে না। কারণ, চীন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। সবার মন আবার ভেঙে যায়। আমরা দেশে ফেরার আশা ছেড়ে দিই। অনিশ্চয়তায় দিন কাটতে থাকে।
আচমকা ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে জানানো হয়, পরদিন আমাদের ফ্লাইট। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভারতের উড়োজাহাজে উঠি। রাত তিনটায় আমাদের ফ্লাইটটি ছাড়ে। আমরা ৯ জন ছাড়াও অন্য শহরে থাকা ১৪ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে পাই ফ্লাইটে। অনেক চেষ্টা, অনেক জল্পনাকল্পনার পর আমরা সবাই যেন চীন ছাড়ি। দিল্লিতে এসে পৌঁছাই সকালে। রানওয়ে থেকে সরাসরি আমাদের আইটিবিপি সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেই আমাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়।
বিশেষ ফ্লাইটে চীন থেকে এসে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশি কয়েকজন শিক্ষার্থী
বিশেষ ফ্লাইটে চীন থেকে এসে ভারতের দিল্লিতে বাংলাদেশি কয়েকজন শিক্ষার্থী
১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন
দিল্লিতে পৌঁছানোর পরই আমাদের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করানো হয়। ১১২ জন বিশেষ ফ্লাইটে গিয়েছিলাম, সবারই করোনাভাইরাস নেগেটিভ আসে। আমাদের কোয়ারেন্টিন শুরু হয়। প্রতিদিন সকালে নাশতার পর আমাদের মেডিকেল চেকআপ করানো হতো। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া আর যেন কোনো কাজ নেই—সাকালে খাই, দুপুরের খাই, বিকেলে নাশতা করি, আবার রাতের খাবার খাই! তবু বাড়ি ফিরছি ভেবে ঘরে বসে থাকি।
দুর্দিনেও আমাদের দিন ভালোই কাটছিল। এমন সময় ২৫ জন ইতালিয়ান নাগরিককে নিয়ে আসা হয়। যাঁদের মধ্যে একজনের করোনাভাইরাস পজিটিভ পাওয়া যায়। এখানে নিয়ে এসে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তখন দেখা যায়, ১৫ জনের পজিটিভ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা প্রথমে অনেক ভয়ে ছিলাম, ইতালিয়ান নাগরিকদের থেকে হয়তোবা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কিছুটা স্বস্তি পেলেও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না।
এভাবে দেখতে দেখতে আমাদের চৌদ্দতম দিনটিও চলে আসে। সেদিন আমাদের আবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়, সেই সময়টি ছিল সবচেয়ে ভয়ানক মুহূর্ত। একজনের যদি পজিটিভ পাওয়া যেত, তখন আমাদের আরও ১৪ দিন সবাইকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হতো।
কিন্তু তখন শঙ্কা দেখা দিল দেশে ফেরার ফ্লাইট নিয়ে। খবরে দেখলাম, সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন টিকিটের ব্যবস্থা করে দিল। ১৪ মার্চ সকালে ভারতীয় সময় দুপুর ১২টায় আমাদের ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়। বেলা আড়াইটায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমাদের ফ্লাইটটি পৌঁছায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনেকে অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা আমাদের আলাদাভাবে বের করে নিয়ে আসেন। অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমরা সবাই সবার ঘরে আমাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসি।
ফিরে এলেও অনিশ্চয়তা যেন পিছু ছাড়ছে না, ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। এখন আমার প্রিয় বাংলাদেশও আক্রান্ত। তবু সান্ত্বনা, পরিবারের সঙ্গে তো আছি।

নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2017 Bdwebs.com
Design & Developed BY Bdwebs.com